দাবা খেলার নিয়ম কানুন ও ইতিহাস


দাবা খেলা:
১৬টি করে ঘুঁটি দ্বারা ৬৪ বর্গক্ষেত্রের একটি বোর্ডে দুইজন খেলোয়াড়ের খেলা। এ ১৬টি ঘুঁটির ১টি রাজা, ১টি মন্ত্রী, ২টি ঘোড়া, ২টি হাতি, ২টি নৌকা ও ৮টি বোড়ে (সৈন্য) থাকে। এ খেলা সম্ভবত ভারতেই প্রথম প্রচলিত ছিল। সেখান থেকে খেলাটি পারস্যে যায়
মুসলমানদের মাধ্যমে ইউরোপে প্রচলিত হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সমগ্র পশ্চিম ইউরোপে এ খেলা ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় পাশা খেলার সঙ্গে এর সাদৃশ্য আছে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন নিয়মে খেলাটি প্রচলিত ছিল। ইউরোপে গত একশ বছরে দাবার বিভিন্ন আইনকানুনের বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে এ খেলাকে সর্বসাধারণের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় করে তোলা হয়। এ বিবর্তনের পথ ধরে দাবাকে ঘিরে গড়ে ওঠে আন্তর্জাতিক দাবা সংস্থা যার প্রধান কার্যালয় সুইজারল্যান্ডে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ আন্তর্জাতিক দাবা সংস্থার সদস্য এবং তারা খেলার আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন মেনে চলে।

দাবা মূলত রাজার খেলা বা রাজায় রাজায় যুদ্ধের খেলা। এ খেলা হয়ে থাকে দুই দলের রাজার মধ্যে। এক রাজাকে কিস্তি দেওয়া বা আক্রমণ করাই অন্য রাজার উদ্দেশ্য। অনেক স্থানে এ খেলাকে কিস্তিমাত খেলাও বলা হয়। যেকোনো উপায়ে রাজাকে বন্দি করাই হলো দাবা খেলার মূল লক্ষ্য। খেলতে খেলতে যে দলের রাজা কিস্তির ফাঁদে আটকা পড়ে বা বন্দি হয়ে যায় সেই রাজার দল পরাজিত হয়

কীভাবে বোর্ড বসাবেনঃ

দাবা খেলার জন্য দুজন খেলোয়াড় দরকার। খেলার জন্য একটা বোর্ড ব্যবহার করা হয়। বোর্ডটি আকৃতিতে বর্গাকার, উপর নিচ এবং পাশাপাশি – দু দিকেই ৮ টি করে চৌকো ঘর থাকে; মোট ৮ ঘরের সংখ্যা ৮*৮ = ৬৪ টা। এর অর্ধেক, অর্থাৎ ৩২ টি সাদা ঘর, বা হালকা রঙের ঘর [light squares] এবং বাকি অর্ধেক ৩২ টি কালো ঘর বা ভারী/গাঢ় রঙের ঘর [dark squares]। অনেক সময় কালো সাদা রঙ এর বদলে অন্য কোনো রঙ ব্যবহার করা হয়। সম্পূর্ণ বোর্ড টি দেখতে নিচের মতো। খেলার সময় বোর্ড এমন ভাবে পাতা হয় যাতে সব সময় ডান দিকের নিচের ঘরটি সাদা রঙের ঘর [light square] হয়।

বোর্ডে ঘর চিহ্নিতকরণঃ

বোর্ড এর প্রত্যেক ঘর কে সহজে চিহ্নিত করার জন্য প্রত্যেক টা ঘরের নামকরণ করা হয় নিচের ছবির মতো। পাশাপাশি ইংরিজি A থেকে H পর্যন্ত এবং নিচ থেকে উপর ১,২,৩ এরকম করে ৮ পর্যন্ত।
এইভাবে প্রত্যেকটা ঘরের একটা করে আলাদা নামকরণ করা হয়। নিচের ছবিতে A1, C7, E4, G6 ইত্যাদি ঘর উদাহরণ দিয়ে দেখানো হয়েছে

ফাইল, র‍্যাঙ্ক ও ডায়াগোনালঃ

উপর নিচ একটা ঘরের সারি কে দাবার ভাষায় ফাইল [file] এবং পাশাপাশি একটা ঘরের সারি কে র‍্যাঙ্ক [rank] বলে। নিচের ছবিতে D-ফাইল এবং পঞ্চম র‍্যাঙ্ক [fifth rank] দেখানো হয়েছে।
দাবার বোর্ডে কোনাকুনি একই লাইনে থাকা ঘরগুলিকে ইংরিজিতে diagonal বলে। যেমন a3-h6 একটা diagonal  এর উদাহরণ।  a8-h1 এবং a1-h8 diagonal বোর্ডের ডায়াগোনাল গুলোর মধ্যে সবচেয়ে লম্বা, তাই এদেরকে লং ডায়াগোনাল বলা হয়।
তাহলে আমরা দাবার বোর্ড বসানো এবং ঘর চিহ্নিত করার পদ্ধতি শিখলাম। এই পদ্ধতিকে দাবার ভাষায় algebric notation বলে। পরে আমরা algebric notation সম্বন্ধে বিস্তারিত শিখবো। এখন আমরা দাবার ঘুটি চিনবো।

ঘুটি পরিচিতিঃ


সবাই খেলতে জানেন ধরে নিয়ে এই সেকশন টাও আগের মতো খুব সংক্ষেপে লিখব। দাবায় মোট ৬ রকমের ঘুটি থাকে
রাজা – king (K),
মন্ত্রী – Queen (Q),
হাতি বা গজ – Bishop (B),
ঘোড়া – knight (N), 
নৌকা – rook (R),
বোড়ে বা সৈন্য  – pawn

ব্রাকেটে ঘুটিগুলোকে ইংরিজি তে সংক্ষেপে লেখার পদ্ধতি দেখানো হয়েছে। রাজা কে K লিখে বোঝানো হয়, এবং রাজা আর ঘোড়া কে আলাদা করার জন্য ঘোড়াকে N লেখা হয়। বোড়ে কে p লেখা যেতে পারে, তবে বোড়ে বোঝাতে সাধারণতঃ কিছু লেখা হয় না। 

এবার আমরা বোর্ডে ঘুটি সাজানো শিখবো। দাবা দুই পক্ষের মধ্যে খেলা হয়। একপক্ষের সাদা ঘুটি এবং অন্যপক্ষের কালো ঘুটি। ঘুটিসমেত সম্পুর্ণ বোর্ড দেখতে নিচের মতো হয়। বোর্ডের উপর ও নিচের প্রান্তে মধ্যভাগের দুটো ঘরে রাজা ও মন্ত্রী বসানো হয়, তারপর দুপাশে গজ, তার দুপাশে ঘোড়া ও একদম প্রান্তে নৌকা বসে। উপর ও নীচ প্রান্ত থেকে দ্বিতীয় সারিতে সাদার ও কালোর [দ্বিতীয় ও সপ্তম র‍্যাঙ্ক] প্রত্যেকের জন্য ৮ টি করে বোড়ে বসানো হয়। খেয়াল করুন, সাদার মন্ত্রী সাদা ঘরে এবং কালোর মন্ত্রী কালো ঘরে বসানো হয়েছে।
বোর্ডকে মাঝামাঝি উপর নিচ দুভাগে ভাগ করলে ছবির ডান দিকে রাজা এবং বামদিনে মন্ত্রী আছে। রাজার দিক কে দাবার ভাষায় kingside বা রাজার দিক এবং মন্ত্রীর দিক কে queenside বা মন্ত্রীর দিক বলে। দ্বিতীয় এবং সপ্তম সারি তে ৮ টি করে বোড়ে থাকে। প্রতিপক্ষের ঘুটি সংখ্যা ১৬ টি, দুইপক্ষ মিলিয়ে মোট ঘুটি সংখ্যা ৩২ টি, মোট ঘর সংখ্যার অর্ধেক।

বিভিন্ন ঘুটির চাল শিখুনঃ


 

খেলার সময় বোর্ডে ঘুটিগুলি কিছু নিয়ম মেনা চলাফেরা করে।প্রত্যেকের চলার ধরণ বাকি ঘুটির থেকে আলাদা। তাই এবার আমরা প্রত্যেকটা ঘুটির চাল এক এক করে শিখবো।

নৌকার চাল

সবার প্রথমে আমরা শিখব নৌকার চাল। নৌকা ফাইল বা রাঙ্ক বরাবর সোজা যাতায়াত করে, রেললাইন এর মতো, সামনে বাধা না থাকলে নৌকা যতদূর খুশি যেতে পারে। নিচের ছবি তে নৌকার চাল দেখানো হয়েছে।

গজ বা হাতির চালঃ

এরপর আমরা শিখব গজ বা হাতির চাল। হাতি কোনাকুনি চলে, ইংরিজি X অক্ষরের মতো। খেয়াল করুন, সাদা রঙের ঘরের হাতি কখনও কালো রং এর ঘরে যেতে পারে না, এবং কালো রঙের হাতি কখনও সাদা রঙ এর ঘরে যেতে পারে না। তাই একটা হাতি দিয়ে সারা বোর্ডের অর্ধেক ঘরে মাত্র যাওয়া যায়। পুরো বোর্ড কভার করতে জোড়া হাতি (bishop pair) দরকার হয়। জোড়া হাতি বলতে একটা সাদা ঘরের হাতি ও একটা কালো ঘরের হাতি বোঝানো হয়।

মন্ত্রীর চালঃ

মন্ত্রী সোজাসুজি বা কোনাকুনি, দু রকম ভাবেই চলতে পারে। বা অন্যভাবে বললে, নৌকা এবং হাতি – এই দু’জনের চাল মেশালে মন্ত্রীর চাল পাওয়া যাবে। নিচের ছবিতে মন্ত্রীর সম্ভাব্য চাল দেখানো হলো। সবদিকে যাওয়ার ক্ষমতা থাকার জন্য মন্ত্রী প্রচন্ড শক্তিশালী। মন্ত্রী আসলে বোর্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী (powerful) ঘুটি।

রাজaর চালঃ 

রাজা মন্ত্রীর মতোই যে কোনো দিকে যেতে পারে, তবে মন্ত্রীর মতো অনেকদূর অবধি যেতে পারে না। রাজা যে কোনো দিকে মাত্র একঘর যেতে পারে। আমরা পরে শিখব রাজা কে বন্দি করা সম্ভব হলে খেলা সমাপ্ত হয়। তাই রাজা কে সবচেয়ে মূল্যবান (valuable) ঘুটি বলা চলে।

ঘোড়ার চালঃ

আমরা চাল শেখার শেষ ধাপে এসে গেছি। এবার আমরা ঘোড়ার চাল শিখব। ঘোড়া যে কোন দিকে দুঘর সোজা গিয়ে একঘর পাশে গিয়ে শেষ করে। ঘোড়ার চাল কে অনেকে আড়াই চাল বা ইংরিজি L এর মতো চাল বলে। নিচের ছবিতে একটা অবস্থান থেকে ঘোড়ার সম্ভাব্য চালগুলো দেখানো হলো। ঘোড়া একমাত্র ঘুটি যে অনান্য ঘুটির উপর দিয়ে লাফিয়ে নিজের গন্তব্যস্থানে পৌছে যেতে পারে।

বোড়ের চালঃ 

বোড়ে শুরুর ঘর থেকে একঘর বা দুইঘর সোজা সামনের দিকে যেতে পারে, কিন্তু একবার শুরুর ঘর থেকে এগিয়ে যাওয়ার পর মাত্র একঘর যেতে পারে। সামনে কোনও বাধা [নিজের বা অপরের ঘুটি] থাকলে বোড়ে আর এগোতে পারে না। বোড়ে পিছনে বা পাশে যেতে পারে না। বোড়ে সামনের দিকে কোনাকুনি খেতে পারে। বোড়ের চাল খুব মন দিয়ে পড়ুন, কারন ঠিকমতো মনোযোগ না দিলে শুরুর দিকে বোড়ের চাল শেখা বেশ কঠিন মনে হয়। নিচে বোড়ের চাল ছবিসমেত ব্যখ্যা করা হলো।
pawn moves
উপরের ছবিতে B2 ঘরের বোড়ে শুরুর অবস্থানে আছে। তাই বোড়ে টি এক চালে B2 থেকে B3 বা B4 জেতে পারে। F4 ঘরের বোড়ে এক চালে শুধুমাত্র f5 জেতে পারে, f6 যেতে পারে না। কারন f4 বোড়েটির শুরুর অবস্থান নয়। f3 ঘরের বোড়েটি আপাতত কোথাও যেতে পারবে না, কারন f4 ঘরটি আপাতত অন্য একজন [নিজের বোড়ে] এর দখলে আছে। এক ই রকম কারনে h6 বোড়ে চলতে পারবে না, কারন h7 ঘরটি অন্য একজন এর [অপর এর বোড়ে] দখলে আছে। d5 ঘরের বোড়ে সোজা d6 ঘরে যেতে পারে, অথবা c6 বা e6 ঘরের অন্যের ঘুটি খেয়ে নিতে (capture) পারে।
তাহলে আমরা সমস্ত ঘুটির চাল শেখা শেষ করলাম।